আজঃ সূর্য, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মানুষের বাকস্বাধীনতা

লিখেছেনঃ রাসেল পঠিত 143 বার
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মানুষের বাকস্বাধীনতা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মানুষের বাকস্বাধীনতা


নীতিমালার নামে মানুষের বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ যেমন নিন্দনীয়, তেমনি স্বাধীনতার নামে সম্প্রচারমাধ্যম এবং পত্রপত্রিকাগুলোর দ্বারা এর অপব্যবহার করে সমাজে টেনশন ও গোলযোগ সৃষ্টিও কাম্য নয়। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্রহরণেরই নামান্তর। তা করা মোটেও সুখকর নয়।

বিশ্বে কোনো দেশে কোনো সময় তা সুফল বয়ে আনেনি। সরকারের কোন আইন বা নীতিমালার বিরুদ্ধে আমি নাই। যে কোনো কিছুর জন্য নীতিমালা থাকা ভালো। সমস্যাটা হলো অপব্যবহারের। আর আমাদের দেশে এ সমস্যাটা প্রকট। আমরা সময় সুযোগ পেলেই যে কোনো কিছুর অপব্যবহার করি। ধরে নিই কোনো এক কামার ধারালো কোনো অস্ত্র (যেমন দা) বানাল নিত্যপ্রয়োজন সারতে। সে দা দিয়ে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করা হলো। তাহলে কর্মটা কেমন হবে? যে অস্ত্র মানুষের কল্যাণে বানানো হলো তা ভালো কাজে ব্যবহার না করে মানুষের গলা কেটে দেয়া হলো। ঠিক তেমনি যে নীতিমালা বাকস্বাধীনতার সৌন্দর্য রক্ষায় প্রণীত হবে, সে নীতিমালা যদি ‘নিয়ন্ত্রণের’ রূপ নিয়ে সেই আকাঙ্খিত স্বাধীনতাকেই টুঁটি চেপে ধরে, তা ঠেকাবে কে? প্রশ্ন হলো, সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদিত নীতিমালাটি যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে প্রণীত হয়েছে কি? সরকার সংশ্লিষ্টদের ভাষায় নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকগণ হয়রানি হবেন না। যদি তাই হয়, তাহলে ভালো কথা। এখানে ষ্পষ্ট যে, বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিষয়গুলো এ আইনেও চারটি ধারায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য। বিচার হবে ট্রাইব্যুনালে, ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা হবে।  প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারার অপপ্রয়োগের ফলে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী দুর্নীতি মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত আইনি অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হবে। ফলে এই ধরনের অপরাধের আরও বিস্তার ঘটবে। এ ছাড়াও অনুসন্ধানীমূলক সাংবাদিকতা ও যে কোনো ধরনের গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এটি আইনে পরিণত হলে তা সংবিধানের মূল চেতনা, বিশেষ করে মুক্ত চিন্তা, বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করবে। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তি কল্যাণ, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিশ্চিতের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে প্রস্তাবিত আইনটি তাতে বাধা সৃষ্টি করবে। গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ভূমিকা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। গণমাধ্যমসহ সকল নাগরিকের সমস্ত ধরনের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে সরকারকে সহযোগিতা প্রদান এবং বাধাহীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে তার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। এ জন্য জনমত যাচাই করা যেতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কোনো সময়ই সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতা ছিল না। কখনো সংবাদপত্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে সেন্সরশিপ, প্রণয়ন করা হয়েছে বিভিন্ন কালাকানুন। গণমাধ্যমের কার্যালয়ে পুলিশের মারমুখী অনুপ্রবেশ, কর্মরত সাংবাদিককে চোর-ডাকাতের মতো আটক করার ঘটনা ঘটেছে অনেক। এবার নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে। সাংবাদিকগন এনিয়ে এখন বেশ সোচ্চার। সুতরাং সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এবং সংবাদপত্র মালিক সংগঠনও এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন।  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধন কিংবা বাতিল না হলে সংবাদিক এবং সংবাদপত্র অনৈতিক চাপের মুখে পড়বেন বৈকি! প্রশ্ন এসেই যায়, আমাদের গণমাধ্যম কি স্বাধীন? সাফ বলতে গেলে আগে কখনো ছিল না, এখনো নেই। সাংবাদিকতার ইতিহাস সেই ইংরেজ আমল থেকে আজ পর্যন্ত সংবাদপত্র কখনোই স্বাধীনতার সূর্য দেখেনি। বরাবরই আমরা সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমে হতাশার চিত্র লক্ষ্য করছি। সব সরকারই গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করতে চায়, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও এর বাইরে নয়। বিএনপি-জামাত সরকার এমনকি তত্ববধায়ক সরকারও গনমাধ্যমের কন্ঠরোধে বেশ পারঙ্গম ছিলো। বিএনপি ক্ষমতাকালীন সময় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে সরকারের পেটোয়াবাহিনী অনুপ্রবেশ করে সাংবাদিকদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে। তাদের আমলে সাংবাদিক নির্যাতন এবং হত্যার বহু ঘটনা ঘটেছে। ১/১১ সময় পত্রিকা অফিসে বিশেষ বাহিনী প্রবেশ করে আঙ্গুল তুলে কোন সংবাদ পত্রিকায় যাবে; আর কোনটা যাবে না তা বলে দেয়া হতো। এ সরকারের সময় এমনটা নয়, তবে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকরা স্বাধীন তা বলা যাবে না। এর আগে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার। মন্ত্রিসভায় এর অনুমোদন এবং গেজেট প্রকাশ করেছে। সংসদের চলতি অধিবেশনে উপস্থাপিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এখন চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। কেন এমন প্রশ্ন সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীমহলের? সংসদের চলতি অধিবেশনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পাস হয়েছে। এ আইনে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ ৫টি ধারা বিলুপ্ত করা হলেও এ ধারার অনুরূপ বেশকিছু বিধান রেখেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ণ করা হয়েছে। বিষয়টি উদ্বেগের।  সাংবাদিক, সংবাদপত্রের মালিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার প্রতিচ্ছবি কিনা তা নিয়েই এখন সবার প্রশ্ন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো ধারা, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অনুলিখন হলেতো শংকা আর প্রশ্ন থাকেই? ভাবিছি, সত্যিই সাংবাদিকদের কন্ঠ রোধের জন্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’ কিনা। অবশ্য আজকাল যেভাবে ডিজিটাল অপপ্রচারকারীর সংখ্যা বাড়ছে তা ভাবনারই বিষয়। মূহুর্তেই উৎভটসব অপপ্রচার চলে নানা ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যমে। তাতে সরকার বিব্রত। কতক পত্রপত্রিকাও এমন প্রচাওে সুখ পায় বটে! তাতে সরকার এমনি বিশেষ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। মিথ্যা প্রচার-প্রচারনা আমাদেরও উৎকন্ঠায় ফেলে। তাই ডিজিটাল অপপ্রচারকারীদের কন্ঠরোধের প্রয়োজন আছে বৈকি!। ডিজিটাল অপপ্রচারকারীদের কন্ঠরোধ করতে গিয়ে যেন সাংবাদিকদের কন্ঠরোধ করা না হয় সেটাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়। সাংবাদিক সমাজে এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সরকারকে দুর করতেই হবে। উৎকন্ঠারও কিন্তু কারন আছে। এর আগে ৫৭ ধারা নিয়ে দেশ জুড়ে সাংবাদিকরা সোচ্চার হয়ে ছিলেন। তখন বলা হয়েছিলো কোন সাংবাদিক এ ধরায় হয়রানীর শিকার হবেন না। কিন্তু আমরা কি দেখেছি? এ ধারায় সাংবাদিকগণই সবচেয়ে বেশি হয়রানীর শিকার হয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলোর অপপ্রয়োগের আশঙ্কা প্রবল।  একটা বিষয় বরাবই আমরা দেখে আসছি, আধুনিক বিশ্বে মোটামুটি সব দেশেই সরকার এবং তার দোসর বাহিনী গণমাধ্যমের ওপর চড়াও হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শক্তি বলে পরিচিত সরকারগুলো যখন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায়, তখন গণমাধ্যমের দুর্দিন নেমে আসে। আর বলতে গেলে আমাদের দেশে সংবাদপত্র প্রকাশের আগেই নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়। সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রকাশক ও মুদ্রণকারীকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘোষণা দিতে হয়। নিয়মিত বা সাময়িক সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হয়। এটি সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশে কতখানি আনুকূল্য তৈরি করতে পারে তা সহজেই বোধগম্য। সরকারি অফিসগুলোর পেছনে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে অনেক সংবাদপত্রের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি লাভের পর নিয়ন্ত্রণরেখার বাইরে পদচারণা করা সম্ভব হয় না সংবাদপত্রের জন্য। সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধের জন্যও অবলম্বিত হয় বিভিন্ন প্রক্রিয়া এবং আইনগত ও মৌখিক সেন্সরশিপ। কখনো কখনো এ সেন্সরশিপ রাতের গভীরে ‘অ্যাডভাইস’ আকারে ফোনের মাধ্যমে এসে আবির্ভূত হয়। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ নিজেও কখনো সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে, মুক্তচিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রেও ভিন্ন পরিবেশ তৈরি করতে পারে। সম্প্রতি সৃজনশীল লেখকদের দৈনিক সংবাদপত্রে মুক্ত হাতে কলাম লিখতে অনুপ্রাণিত দেখা যাচ্ছে। চিন্তাজগতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি কলাম লেখক হিসেবে তাদের ভূমিকা যদি মুখ্য হয়ে ওঠে, সংবাদপত্রের আদর্শ, দর্শন ও চিন্তা যদি তাদের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করতে উদ্যোগ নেয়, তাহলে একদিকে সৃজনশীল সাহিত্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে, অন্যদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মুক্ত-আকাশের পরিসর সীমিত হয়ে উঠবে।